গত সপ্তাহের লেখায় আমি Surveillance Capitalism-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলাম। কিন্তু বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়নি, কোনো বিশ্লেষণও হাজির করা হয়নি। বর্তমান করোনা মহামারীর সময় আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের সরকার এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বেশ তৎপর।
করোনা সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে নাগাদ খোলা হবে এবং এগুলো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করতে পারবে তা বলা যায় না।
বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কর্মকাণ্ড থেমে গেছে। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে হোঁচট খাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানকল্পে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনলাইন টিচিং চালু করার পরামর্শ দিচ্ছে।
আমার জানামতে দু’-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন পাঠদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন পাঠদান চালু হওয়ার ফলে সেশনজট সৃষ্টি হওয়ার সমস্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তবে ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন ব্যবস্থা মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারছে না।
কারণ, অনেকেরই ল্যাপটপ নেই। বাসায় ওয়াইফাই সংযোগও নেই। এগুলো সংগ্রহ করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। ওয়াইফাই সংযোগের জন্য ব্রডব্যান্ড কোম্পানিগুলোকে প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ প্রদান করতে হবে।
নিয়মিত বিল পরিশোধ করা হলেও অনেক সময় কারিগরি ত্রুটির কারণে ব্রডব্যান্ড ফ্যাসিলিটি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ছাত্রদের জন্য অনলাইন কানেকটিভিটি বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করার জন্য মোবাইল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।
এসব সমস্যার সমাধান পাওয়া গেলে অনলাইনে পাঠদান অনেকটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। শ্রেণিকক্ষে লেকচার দিয়ে যে শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু ছিল তার বিপরীতে অনলাইন পদ্ধতি সন্তোষজনক বিকল্প নয়।
হাজার হাজার বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু-শিষ্যের সরাসরি অবস্থান আনন্দের বিষয়ে পরিণত হয়। আনন্দহীন শিক্ষা শিক্ষার্থীর জন্য হয়ে ওঠে একেবারেই রস-কষহীন। অন্যদিকে ক্লাসরুমে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সম্মিলিত উপস্থিতিতে পাঠদান হয়ে ওঠে অনেক বেশি আনন্দময়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য ব্যক্ত করেছিল। সেই থেকে ১২ বছর পার হয়ে যাচ্ছে, কাজের কাজ যে তেমন কিছুই হয়নি সেটা এখন করোনাকালে আমরা টের পাচ্ছি।
একটি দেশকে ডিজিটাল কমিউনিকেশন ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য অনেক কাজ করতে হয়। এতদিনে সেই কাজগুলো করা হলে বর্তমানে যে সমস্যা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ক্ষতি করছে সেগুলো এড়ানো সম্ভব হতো।
Surveillance Capitalism-এর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে যে বিষয়গুলো সামনে এসেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে মানুষের অভিজ্ঞতাকে গোপন বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
এই বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়া, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করতে পারা এবং জিনিসপত্র বিক্রয় করা। ২. এ ধরনের পুঁজিবাদ পরজীবী অর্থনৈতিক যুক্তির ওপর নির্ভরশীল।
এক্ষেত্রে পণ্য ও সেবার উৎপাদন মানবগোষ্ঠীর আচরণগত পরিবর্তনের অধীন করা হয়। ৩. এ ধরনের পুঁজিবাদে সম্পদ, জ্ঞান ও ক্ষমতা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে, মানবজাতির ইতিহাসে তার কোনো দৃষ্টান্ত নেই।
৪. Surveillance Economy-এর ভিত্তিগত কাঠামো থাকে। ৫. একবিংশ শতাব্দীতে এই পুঁজিবাদ মানুষের স্বভাবের জন্য একটি হুমকির উৎস। একইভাবে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে শিল্প পুঁজিবাদ প্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
৬. নতুন যন্ত্রায়িত ক্ষমতা সমাজের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং বাজারভিত্তিক গণতন্ত্রের জন্য অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। ৭. Surveillance Capitalism বিশ্ব পরিসরে একটি নতুন ধরনের যৌথ ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়, যার ভিত্তি হল পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা।
৮. অতি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার লুণ্ঠিত হয়। এ প্রক্রিয়াটি হল উপর থেকে একটি অভ্যুত্থান চাপিয়ে দেয়া, যার ফলে জনগণের সার্বভৌমত্ব উৎপাটিত হয়। এ বিষয়গুলো সহজভাবে বলতে গেলে এ কথাই বোঝায় যে, বিংশ শতাব্দীতে শিল্প পুঁজির বিকাশ ঘটেছিল প্রকৃতির ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করে।
শিল্পের চিমনির ধোঁয়ায় বৃক্ষরাজি মানবজাতিকে সবুজের যে স্নিগ্ধতা প্রদান করে সেটি হারিয়ে যায়। Surveillance পুঁজিবাদ হল এমন একটি ব্যবস্থা, যা মানুষের স্বাভাবিক চরিত্রকে পরিবর্তন করে উপর থেকে অনেক কিছু চাপিয়ে দেয়।
এর ফলস্বরূপ জনগণ সার্বভৌমত্ব হারায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান গভীরভাবে মানুষের মেজাজ ও মজ্জায় প্রবিষ্ট করে দেয়ার ফলে মানুষ ভুলে গেছে যে তার একটি সত্তা ছিল এবং তার এই সত্তার স্ফুরণ ঘটে যে ব্যবস্থায় সেটাই হল জনগণের সার্বভৌমত্ব। আমরা গণতন্ত্র চাই অর্থাৎ জনগণের সার্বভৌমত্ব চাই।
Surveillance Capitalism-এ গুগলের যে অবস্থান, অনুরূপ অবস্থান ছিল ফোর্ড মোটর কোম্পানি এবং জেনারেল মোটরসের অঢেল উৎপাদনভিত্তিক ব্যবস্থাপনা-পুঁজিবাদের। সেই সময়কার পুঁজিবাদে নতুন অর্থনৈতিক যুক্তি এবং এগুলোর বাণিজ্যিক মডেল আবিষ্কার করা হয়। মানুষই এগুলো করেছে।
তারপর Trial and Error-এর মধ্য দিয়ে এগুলোকে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত করা হয়েছে। আমাদের সময়ে গুগল হচ্ছে অগ্রদূত। এই অগ্রদূত আবিষ্কার, বিস্তৃতকরণ, পরীক্ষণ এবং নেতৃস্থানীয় ব্যবহারবাদীর ভূমিকা পালন করছে। এটি একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, Surveillance Capitalism-এর প্রসারণে কেন্দ্রীয় আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ফোর্ড ও জিএম পরিণত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদের স্নায়ুকেন্দ্রে। এ কোম্পানিগুলো নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে।
এগুলো থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গেছে সেগুলো বিশ্ব পুঁজিবাদের বিভিন্ন উৎপাদনকেন্দ্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। গুগল যে ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো উচিত। এ পরীক্ষা-নিরীক্ষার লক্ষ্য একটি কোম্পানিকে বিশেষ উদ্দেশ্যে বেছে নেয়া নয়।
শুধু এ কোম্পানির দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করাতে এ প্রয়াস সীমিত থাকবে না। বরং পুঁজিবাদের এ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে পুঁজিবাদের নতুন যুগে পুঁজিবাদের ক্ষমতাকে নতুন রূপ দিয়েছে সেটি বুঝতে হবে।
ফোর্ড ও জিএম ব্যাপক ও বিশাল উৎপাদনের সূচনা করেছিল। তাদের এ উৎপাদনের সূচনার পর শত শত গবেষক, ব্যবসায়ী, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন কোন পরিস্থিতিতে এটি উদ্ভাবিত হল, এর শেকড় কোথায় ইত্যাদি।
পরবর্তীকালে পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে দেখিয়েছেন মানুষ ও কোম্পানি হিসেবে ফোর্ড কেমন। জিএম কোম্পানিটিও গভীর অনুসন্ধানের বিষয়ে পরিণত হয়। পিটার ড্রাকার মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে কর্পোরেশনের ধারণাটিকে তুলে ধরেন এবং একটি ভালো কর্পোরেশনের ব্যবসা সংগঠনের বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক হাল ভেরিয়ান দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করে নামকরা জার্নালে প্রকাশ করেছেন। ভেরিয়ান তল্লাশি চালিয়ে বুঝতে চেয়েছেন Computer-Mediated Transactions আসলে কী।
এবং আধুনিক অর্থনীতির রূপান্তরে এর ভূমিকা কী। ভেরিয়ান লিখেছেন, ‘Nowadays there is a computer in the middle of virtually every transaction… now that they are available these computers have several other uses.’ ভেরিয়ান তার আলোচনায় কম্পিউটারের যেসব নতুন ব্যবহারের কথা বলেছেন সেগুলো Surveillance Capitalism-এর অদ্ভুত লজিকের অপ্রত্যাশিত নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করছে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্ঞানের বিভিন্নমুখী বিভাজন এবং তথ্য সভ্যতার চরিত্র কী তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। আজকাল যারাই Data Extraction I Analysis নিয়ে কথা তোলেন তারা বিগ ডেটার কথা বলেন। এই ডেটাই হল Surveillance Capitalism-এর কাঁচামাল।
এ Surveillance Capitalism-এ যা কিছু উৎপাদন করা হয় তার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিগ ডেটা। ডেটা এক্সট্রাকশন দ্বারা সামাজিক সম্পর্ক এবং বস্তুগত অবকাঠামো বোঝা সম্ভব হয়। এই ডেটা বা তথ্যের সুবাদে একটি ফার্ম এর বস্তুগত অবকাঠামো দিয়ে অন্য ফার্মগুলোর ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করতে পারে। কাঁচামালের ওপর কর্তৃত্ব থাকার ফলে ফার্মটি তার উৎপাদনের পরিমাণ স্থির করে বাজারে কম খরচে এগুলো সরবরাহ করতে পারে।
আমাদের দেশে যেভাবে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে কম্পিউটার ব্যবহার করা হচ্ছে তার দরুন আর্থ-সামাজিক অবস্থা কী রূপ ধারণ করবে, তা আমাদের গবেষণা করে খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে করোনা-পরবর্তীকালে যে ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টির আশঙ্কা আছে, আমরা সেই মন্দাজনিত অবস্থা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারব না।
দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের মাধ্যমে বিশাল একটুকরো বিগ ডেটা সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ডেটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে, হয়তো ব্যবহৃত হচ্ছেও। এখন অনলাইন পাঠদানের মাধ্যমেও আরেক ধরনের বিগ ডেটা সৃষ্টি হবে।
এ ডেটার ব্যবহার ও অপব্যবহার সম্পর্কেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে। আমাদের টেলিফোন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা শুধু সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের টেলিফোন সংলাপ টেপ করতে ব্যস্ত থাকলে এ সংস্থার হাতে বিগ ডেটার যে ভাণ্ডার আছে তার অপব্যবহারের আশঙ্কাও অমূলক নয়। এজন্যই পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা এ টেকনোলজির অপব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত।
সর্বোপরি, তারা মনে করেন সব মিলিয়ে Surveillance Capitalism-এর নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্র ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়ে আগ্রাসন চালাচ্ছে এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ