মাহমুদুল হক আনসারী: সমাজে বিতর্কের শেষ নেই। ভালো-মন্দ বুঝে না বুঝে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি আমরা। বিতর্ক হয় রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, দুর্নীতি ও সেবামূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে। একশ্রেণির লোক সবকিছুতে বিতর্ক করতে অভ্যস্ত। বিতর্ক যদি হয় সমাজ সংস্কারে, দেশ ও জাতির স্বার্থে গঠনমূলক সমালোচনা সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। অহেতুক বাড়াবাড়ি সেটা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। শিক্ষা অর্জন সব মানুষের জন্য অবশ্যই একটি নির্দেশ। শিক্ষা ছাড়া ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কখনও এগোতে পারে না। নীতি নৈতিকতা, আদর্শ চরিত্র গঠনে জ্ঞান অর্জন অবশ্যই থাকতে হবে।
শিক্ষা ছাড়া ব্যক্তি পরিবার রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট ধর্ম, গোত্র, পেশার মানুষের জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষা বলে কোনো কিছু নেই। একটি দেশে সব ধর্ম শ্রেণি-পেশার মানুষের বসবাস। জাতীয় স্বার্থে সব মানুষের জন্য শিক্ষা অর্জনের পথ সুগম করতে হবে। শিক্ষা অর্জনে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা জাতিকে পেছনে ঠেলে দেয়ার শামিল। কোনো ধর্মের মধ্যে জ্ঞান আহরণকে নিষেধ করা হয়নি। বরং জ্ঞান অর্জনকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এখানে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ করা হয়নি।
ইসলামের নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) জ্ঞান অর্জনে মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্য দেশে পাড়ি দিতেও নির্দেশ দিয়েছেন। জীবনের শুরু থেকে মৃত্যুর শয্যায় পর্যন্ত জ্ঞান আহরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এসব বাণী ইসলামের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর প্রসিদ্ধ সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনার মাধ্যমে গোটা পৃথিবীবাসী অবগত। বিংশ শতাব্দীর এ যুগে পৃথিবী যখন প্রতিটি মুহূর্তে বিজলির মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগোতে চলছে, তখন ধর্মের দোহাই তুলে শিক্ষা থেকে একটি গোষ্ঠীকে সংকুচিত করার কথা বলা এক ধরনের অধার্মিক কথা বলে জাতি মনে করছে। নারী-পুরুষের শিক্ষায় জ্ঞান আহরণে বিভাজনের কথা আমার জানা নেই।
দুনিয়ার শুরু থেকে শিক্ষা-দীক্ষায় নারী জাতির অবদান অনস্বীকার্য। ঘর থেকে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীর অবদান ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী তার ব্যাপ্তিকে বেশি সম্প্রসারিত করেছে। এটা এক দিনে সম্ভব হয়নি। নারীর প্রতি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ দায়িত্বশীল পরিবেশ সৃষ্টি করায় তা সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিপার্শিক অবস্থার কারণে মুসলিম নারী সমাজকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষায় অনেক পেছনে রেখেছিল তখনও ধর্মের দোহাই দিয়ে। মুসলিম নারী সমাজকে শিক্ষা থেকে অনেকাংশে দূরে সরে রাখার কারণে মুসলিম সমাজ এর গ্লানি এখনও পর্যন্ত তিলে তিলে ভোগ করছে।
সারা পৃথিবী যখন সম্মিলিতভাবে এগিয়ে চলছে, তখন আমাদের দেশে আবার বিতর্ক নারীশিক্ষা নিয়ে। সাম্প্রতিক চট্টগ্রামের হাটহাজারী মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার একটি সভায় হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী নারীদের ফোর-ফাইভের বেশি না পড়াতে তার ভক্তদের আহ্বান জানিয়েছেন। এ বক্তব্য নিয়ে সারা দেশে বিতর্কের শুরু। এমন বক্তব্য তিনি রাখলেন, যে বক্তব্যের সঙ্গে স্বয়ং তার অনুসারীদের মধ্যেও বিতর্ক। কারণ তাদের মতাদর্শের অনেক অনুসারী আলাদাভাবে মহিলাদের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। সারা দেশে লাখ লাখ নারী শিক্ষার্থী ওইসব মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। তারা সেখান থেকে পাস করে শিক্ষকতাসহ নানা পেশায় যুক্ত হচ্ছে। তাহলেই শফি সাহেব এ বয়সে এসে নারী শিক্ষা নিয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়ে আরেকটি জাতীয় বিতর্ক সৃষ্টির কী দরকার ছিল? ধর্মীয় দৃষ্টিকোণেও তার বক্তব্য স্ববিরোধী। যে সংগঠনের তিনি আমির সেটার নাম বাংলায় বললে ইসলামের সংরক্ষণকারী। এটাও গ্রহণযোগ্য নাম হতে পারে না। কারণ ইসলাম আল্লাহর গ্রহণযোগ্য ও মনোনীত একটি ধর্ম। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর ধর্মকে হেফাজত করবেন। সেখানেও শফি সাহেবরা বাস্তবে ধর্মকে হেফাজতের কথা বলে ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কের জš§ দিচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের দেশে যেহেতু সব ধর্ম গোত্রের মানুষের বসবাস, সেহেতু এখানে আলাদা আলাদা সব ধর্মের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা জাতীয়ভাবে সম্ভব না। জাতীয় শিক্ষা কাযর্ক্রম কারিকুলাম সবার জন্য একমুখী। এখানে ধর্মীয়ভাবে আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের আচার অনুষ্ঠান ভিন্ন হওয়ার কারণে সামাজিক সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। ধর্মের কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে কাউকে বঞ্চিত করার অথবা বিরত রাখার কথা বলা এক ধরনের অপরাধ। রাষ্ট্রের নিয়ম নীতি সংবিধানবিরোধী বক্তব্য প্রচেষ্টা চালানো সেটাও অপরাধ। দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী মানুষ। নারী সমাজ শিক্ষা জ্ঞানে যোগ্যতায় এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রীও। নারী শিক্ষায় অগ্রগতিতে এত অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের পরও নারীদের ছোট করে দেখার কোনো জায়গা নেই। বাংলাদেশের নারী দেশে যেভাবে সফল, দেশের বাইরেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার সংবাদ পাওয়া যায়। বলা যায়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের এখনও প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এগোতে হচ্ছে। এখনও নারীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে তাদের অনেক নাগরিক অধিকার থেকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বঞ্চিত হচ্ছে। ঘরে-বাইরে চলাচলে নারীর প্রতি এখনও সমাজ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে হয় না। তবুও বাংলাদেশের সাহসী নারীরা শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, খেলাধুলা, পরিবার ও সামাজিক কাজে তাদের সাফল্য অর্জন করেই যাচ্ছে। এত কিছুর পরও নারীকে শিক্ষা অর্জন, কর্মক্ষেত্র তাদের সামাজিক মর্যাদা দিতে কোন জায়গায় সমস্যা, সেটা আমার মতো অনেকেই বুঝে উঠতে পারছে না।
একজন নারীর শিক্ষা অর্থ একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শিক্ষার আলোতে গড়ে তোলা। একজন নারী কখনও রাষ্ট্রপ্রধান, কখনও শিক্ষক, কখনও গৃহিণী। সব ক্ষেত্রেই নারী জাতি তার আপন যোগ্যতা এবং চারিত্রিক মাধুর্যতায় এগিয়ে আছে। যারা এ জাতিকে পেছনে রেখে দিতে চায় অথবা নিয়ে যেতে চায় তাদের মুখেই শোভা পায় নারী শিক্ষাবিরোধী বক্তব্য। তবে হাজার চেষ্টা করলেও তাদের এসব রাষ্ট্র ও সংবিধানবিরোধী বক্তব্যের সঙ্গে জনসমর্থন মিলবে না। এসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিদিন সারা দেশে সভা-সমাবেশ প্রতিবাদ হচ্ছে। জনগণের পক্ষ থেকে ওই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। দেশ যখন শিক্ষা-দীক্ষায় সফলতায় এগোচ্ছে, তখন এ ধরনের জনবিরোধী বক্তব্য দিয়ে কখনও ধর্মের মঙ্গল সম্ভব নয়। নারী জাতিকে শিক্ষায় পেছনে ফেলে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কোনো কাজেই সফলতা আসবে না। তবে কিছু কিছু বিষয় নারী শিক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নারীর নিরাপত্তা, নৈতিক শিক্ষা, শালীনতা বজায় রেখে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এসব বিষয় চিন্তায় এনে নারীর শিক্ষা ও অধিকার সমাজকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনো অবস্থায় নারীকে শিক্ষা আহরণ থেকে ফেলে রেখে জাতীয় অগ্রগতি কখনও সম্ভব নয়। তাই আসুন নারীর প্রতি শিক্ষা কর্মক্ষেত্র ঘরে-বাইরে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখি। অহেতুক তর্ক-বিতর্ক করে নারী শিক্ষা সংকোচনের সব চক্রান্ত প্রতিহত করি।